শিশু স্বাস্থ্য

শিশু কেন খেতে চায় না?

শিশুর খেতে না চাওয়া বেশ প্রচলিত একটি সমস্যা। শিশুর খাবারের ওপর তার বৃদ্ধি, পুষ্টি-এসব বিষয় জড়িত। তাই কী কারণে শিশুটি খেতে চায় না এই বিষয়টি খতিয়ে দেখা জরুরি। ২৩ অক্টোবর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৮৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ডা. তামান্না বেগম।
প্রশ্ন :  প্রত্যেক মায়ের অত্যন্ত সাধারণ একটি সমস্যা, আমার বাচ্চাটি খেতে চায় না। কী বলবেন এই ক্ষেত্রে?
উত্তর : আসলে আমি তো বলি এটি সবারই সমস্যা। কারণ আজকাল দেখি সব মাই বলতে থাকেন, ডাক্তারসাহেব আমার বাচ্চাটি খেতে চায় না; কী করব? এখন খেতে না চাওয়া সত্যি সত্যিই একটি বড় সমস্যা। আজকাল সবার ঘরে একটা-দুটো বাচ্চা। আর তারাও যদি খেতে না চায়, মায়েরা নিশ্চয়ই চিন্তায় থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাই সবার মুখে মুখেই শুনবেন বাচ্চাটি খেতে চায় না। এই জিনিসটি খুব গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। আমাদের দেখতে হবে বাচ্চা ঠিকমতো বাড়ছে কি না। সে জন্য নিয়মিত বাচ্চার ওজন দেখতে হবে। তার উচ্চতা ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তার বয়সের অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় বৃদ্ধি ঠিকমতো হচ্ছে কি না। বাচ্চার যে মাইলস্টোন ডেভেলপমেন্ট বলি, খেলাধুলা, চালচলন, কার্যক্রম সব ঠিক আছে কি না- এসব দেখতে হবে।
https://amarsastha.blogspot.com/

এগুলো যদি সব ঠিক থাকে, তাহলে আমরা দেখি মায়ের কোনো সমস্যা কি না। অনেক সময় আমরা দেখি মায়েরা খুব জোরাজুরি করেন শিশুকে খাওয়ানোর জন্য। একটু খাওয়া নিয়ে সারা দিন বাচ্চার পেছনে ঘোরাঘুরি করেন। তারপর হয়তো একই খাবার প্রতিদিন দেন, রোজ খিচুড়ি, রোজ সুজি- এগুলোতে বাচ্চারা বিরক্ত হয়ে যায়। এসব বিষয়গুলো দেখতে হবে। এরপর দেখতে হবে মা খাওয়ার জন্য বাচ্চাকে খুব মারধর করছে কি না। এই জিনিসগুলো মাকে বোঝাতে হবে। মাকে এমনভাবে বোঝাতে হবে, মা যেন বিরক্ত হয়ে না যান। বোঝাতে হবে, আপনার বাচ্চার ওজন ঠিক আছে, বাড়ছে ঠিকমতো, তাহলে আপনার একঘেয়ে খাবারে একটু পরিবর্তন আনতে হবে। খাবারটা রঙিন হতে হবে, মারধর করবেন না, খাবার একটু বিরতি দিয়ে খাওয়াতে হবে।

যেমন, ছয় মাসের একটি বাচ্চা। তাকে আপনি বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, আবার বাড়তি খাবারও খাওয়াচ্ছেন। তাহলে তার খাবারটি কয়বার হওয়া উচিত। দুধ তার প্রধান খাবার। পাশাপাশি বাড়তি খাবার দেবেন। তাকে দুবার বাড়তি খাবার দিতে হবে। আড়াইশ এমএলের বাটির আধা বাটি সকালে এবং রাতে বা দুপুরে এবং রাতে খাওয়াতে হবে। সেটা না করে যদি খুব ঘন ঘন, এক চামচ, দুই চামচ করে খাওয়ান তখন খাবারের প্রতি শিশুর বিরক্তি চলে আসে। তাই বিরতি দিয়ে খাওয়াতে হবে। আড়াই ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা পরপর খাওয়াতে হবে। এটি হবে বয়স অনুসারে। এবং পরিমাণটিও গুরুত্বপূর্ণ। আমি এক বাটি খাবার নিয়ে বসে থাকলাম। বাচ্চার সেটা প্রয়োজন নেই। তাই কতটুকু তার প্রয়োজন, কতটুকু তাকে খাওয়াতে হবে এবং কতটুকু বিরতি দিতে হবে ওই বয়স পর্যন্ত, মাকে সেটি জানতে হবে।

আরেকটি বলতে হবে, কোনোভাবেই খাওয়া নিয়ে বাচ্চাকে মারধর করা যাবে না। তাহলে খাওয়ার প্রতি আগ্রহ থাকবে না, অনীহা চলে আসবে।
প্রশ্ন : পাশাপাশি বাচ্চার পায়খানা, প্রস্রাব ঠিকমতো হচ্ছে কি না সেটিও কী মাথায় রাখতে হবে?
উত্তর : হ্যাঁ, সেটিও মাথায় রাখতে হবে। বলব যে, প্রতিদিন ওর প্রস্রাব ঠিকমতো হচ্ছে, পায়খানা ঠিকমতো হচ্ছে তাহলে আপনি কেন এত ভাবছেন?
প্রশ্ন: একটু জানতে চাই, এক বছরের বাচ্চার পায়খানা-প্রস্রাব কয়বার হলে ভালো হয়?
উত্তর : যে বাচ্চাটি নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করে, তার দিনে একবার পায়খানা হলে বুঝব ঠিক আছে। তারপর যদি দুবার হয় কোনো অসুবিধা নেই। প্রথম সময় হয়তো অল্প একটু করেছে। পরে আরেকবার করে পরিষ্কার হয়ে গেল। তাহলে তার জন্য চিন্তার কারণ নেই।
আমরা অনেকে বাচ্চাকে আলাদাভাবে খেতে দিই। তবে পরিবারের লোকজন যখন খায় তাদের সঙ্গে যদি বসাই, সবার খাওয়াটা সে দেখবে। তখন তার নিজে নিজে খাওয়ার অভ্যাস হবে।
প্রশ্ন : আমরা আলাদা করে বাচ্চাদের জন্য একটি খাবার তৈরি করি। আমার মনে হয় সেটি না করে হাঁড়ির খাবার, যেটা সবাই খাচ্ছি, সেটা যাতে বাচ্চারা খেতে পারে। সেই দিকটি একটু মাথায় রাখতে হবে। এ বিষয়ে কী বলেন?
উত্তর : আসলে বাচ্চা যদি ছোট থাকে, তাকে ঘরের তৈরি খাবারটিই নরম করে দিতে হবে। তার জন্য অনেকে বলেন, খাবার ব্ল্যান্ডারে পিষে নিই, স্যুপ করে দিই। এগুলোর তেমন দরকার নেই। আমরা পরিবারে যেই খাবারটুকু খাই সেটাই একটু বাচ্চাকে নরম করে দিতে হবে। এর মধ্যে শাকসবজি, মাছ, মাংস- আমরা যেটা খাই সেটাই দেব। কিন্তু খুব লবণ বা খুব ঝাল দেব না। বাচ্চা যাতে খেতে পচ্ছন্দ করে এমন রঙিন করে দেব। যেন দেখে বাচ্চা খেতে চায়। এভাবে তাকে যতটুকু দরকার ততটুকু খেতে দিতে হবে।
প্রশ্ন : আমরা অনেক সময় দেখি, টিভি দিয়ে বা একগাদা খেলনা দিয়ে বাচ্চাটিকে বসিয়ে রেখেছে এবং সেভাবে খাওয়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাচ্চাটির কি খাওয়ার প্রতি মনোযোগ থাকে?
উত্তর : আসলে বাচ্চার যদি অনেক খেলনা থাকে, তার মন ওই খেলনার দিকে চলে যায়। অনেক সময় আমাদের এগুলো ব্যবহার করতে হয়। তবে খুব বেশি জিনিস আমরা ব্যবহার করব না, এতে মনোযোগ ভিন্ন দিকে চলে যাবে। এটি খাওয়ার আগ্রহ কমিয়ে দেবে। এগুলো আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের যেটা করতে হবে, বাচ্চার বয়স অনুযায়ী সে যদি ঠিকমতো বড় হয়, ওজন ঠিকমতো থাকে, তার যদি বৃদ্ধি, কাজকর্ম ঠিক থাকে তাহলে মাকে বলতে হবে বাচ্চা না খেলে চিন্তার কারণ নেই।
তবে কিছু বাচ্চা আছে যারা সত্যি সত্যি খায় না। এবং বৃদ্ধিটাও ঠিকমতো হয় না। তাহলে দেখতে হবে বাচ্চাটি কি অপুষ্টির শিকার হচ্ছে কি না বা তার রক্তশূন্যতা হয়েছে? না কি বাচ্চার ঘন ঘন কোনো সংক্রমণ হচ্ছে, যার জন্য খাওয়ার রুচি কমে যাচ্ছে? যদি শিশুটির এনিমিয়া বা রক্তশূন্যতা থাকে, অপুষ্টি থাকে- বাচ্চাটি বসে থাকবে, খুব বেশি সচল থাকবে না। তাহলে এগুলো দেখতে হবে। পাশাপাশি কৃমি আছে কি না দেখতে হবে। এ ছাড়া কিছু বাচ্চার থেলাসেমিয়া থাকতে পারে, অ্যাজমা থাকতে পারে, হয় তো ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন আছে– তখন বাচ্চাটিকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সে যে খায় না, এর কারণ কী খুঁজতে হবে? শুধুই কি ক্ষুধামান্দ্য না কি সঙ্গে আর কিছু রয়েছে, সেসব দেখতে হবে। দেখে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।
রক্তশূন্যতা আছে কি না, এর জন্য হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করে দেখতে পারি। কোনো ইনফেকশন আছে কি না, সেটা দেখতে রক্ত পরীক্ষা করতে পারি, প্রস্রাব পরীক্ষা করতে পারি। সমস্যা যদি সামান্য হয়, তাহলে তো ঠিক সময়ে চিকিৎসা করলে বৃদ্ধি ব্যাহতও হলো না, ক্ষুধামান্দ্য ভাবও থাকল না। তবে যদি সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি হলে, অনেক সময় লাগে। অনেক বাচ্চার কনজিনিটাল হার্টের সমস্যা থাকে। এটার ফলে শিশুরা অপুষ্টির শিকার হয়। অনেক বাচ্চার জন্মগত সমস্যা হয়।
প্রশ্ন : কনজিনিটাল হার্ট ডিজিজ বোঝার কি কোনো উপায় রয়েছে?
উত্তর : হ্যাঁ, বোঝা যায়। অনেক বাচ্চার ক্ষেত্রে মা বলবে, সে কাঁদতে কাঁদতে হয়তো নীল হয়ে যায়। খাওয়াতে গেলে শ্বাস নিতে পারে না। কিছুদিন পরপর তার শ্বাসকষ্ট হয়, কাশি হয়, ঠান্ডা লাগে – এগুলো দেখলে তখন আমরা পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করি।
তাহলে খায় না বললে, একদিকে আমরা হেসে উড়িয়ে দিলাম। আরেকদিকে আমাদের চিন্তা করতে হবে আসলেই কোনো সমস্যা আছে কি না।
প্রশ্ন : সাধারণত আমরা দেখি, মায়েদের আসলে খুব মোটাসোটা বাচ্চা না হলে ভালো লাগে না। এ ক্ষেত্রে আপনার কী মনে হয়?
উত্তর : আপনি জানেন, জিনগতভাবে শিশুটির বাবা-মায়ের গঠন যেমন হবে, তার গঠনটিও তেমন হবে। অনেক মায়েরা মোটা থাকেন, বাচ্চাটি রোগা থাকে। মায়েরা বলেন, আমার স্বাস্থ্য দেখেন, সবাই বলে বাচ্চার সব খাবার হয়তো আমি খাই। তবে দেখা গেল বাচ্চার বাবা হয়তো অতটা স্বাস্থ্যবান নয়। তখন আমরা বলি আপনার গঠন হয়তো পায়নি। বাবারটি পেয়েছে। আর মোটাসোটা হলেই কি ভালো? বাচ্চা তো সুস্থ আছে, সে খেলাধুলা করছে, ওজন বয়স অনুযায়ী ঠিক আছে, বৃদ্ধি ঠিক আছে। তাহলে কি আপনি মোটা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবেন নাকি বাচ্চার সুস্থতা দেখবেন।
আসলে বাচ্চা সুস্থ আছে কি না এই বিষয়টি মায়েদের খেয়াল রাখতে হবে। 


সন্তানকে স্তন্যদানের উপকারিতা

অর্কাইভ্স অফ জেনারেল সাইকিয়াট্রির ২০০৮-এর মে সংখ্যায় ক্যানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির মাইকেল ক্রেমার ও তাঁর সহকর্মীরা একটি গবেষণা পত্রে বলেছেন যে, শিশুরা জন্মাবার পর থেকে তিন মাস বা তার অধিক সময়ে শুধু মায়ের দুধ খেয়ে বড় হলে, বেশি বুদ্ধিমান হয়। ৬ বছর বয়সে এইসব শিশুদের আই.কিউ (I.Q.*) বা বুদ্ধ্যাঙ্ক মেপে দেখা গিয়েছে যে, তারা অন্য শিশুদের থেকে ৬ পয়েণ্ট এগিয়ে আছে। এর আগেও এ ব্যাপারে কিছু কিছু অনুসন্ধান হয়েছে, তবে এতটা ব্যাপক ভাবে কোনও সমীক্ষা আগে করা হয় নি। মোটামুটি ভাবে আগেও মনে করা হত যে যারা শিশু অবস্থায় শুধু মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়েছে তাদের চিন্তাশক্তির ক্ষমতা, শেখার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি, ইত্যাদি ফর্মুলা খেয়ে বড় হওয়া শিশুদের থেকে একটু বেশি।
কেন শুধু মায়ের স্তন্যপান করে বড় হলে চিন্তাশক্তি বাড়ে তার কারণ কিন্তু পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় নি। এর কারণ মায়ের দুধের কোনও বিশেষ অনুপানের জন্য না স্তন্যপান কালে মায়ের সান্নিধ্য শিশুর চিন্তাশক্তিকে উদ্দীপ্ত করছে - সে নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করেন মায়ের দুধের কিছু পুষ্টিকারক বস্তু, যেমন কিছু অ্যামিনো অ্যাসিড, বাজারে কেনা ফর্মুলায় থাকে না। এই অ্যামিনো অ্যাসিডের মধ্যে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ডোকোসাহেক্সানোইক অ্যাসিড আছে - যেগুলো শিশুর মস্তিষ্ক-বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। আমেরিকার শিশু-বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা অবশ্য নতুন মায়েদের স্তন্যদান করতে পরামর্শ দেন অন্য কারণে। মায়ের দুধ খেলে বাচ্চাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং তাদের দেহের প্রতিরোধশক্তি বর্ধিত হয়। যেসব শিশু মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়, তাদের কানের অসুখ, পেটের অসুখ, অ্যালার্জি, ইত্যাদি বোতলে ফর্মুলা খাওয়া বাচ্চাদের থেকে কম হয়।
প্রসঙ্গতঃ সন্তান জন্মের কিছু আগে থেকেই নারীদের স্তনে দুধ সৃষ্টি হয়। প্রথম দিকের দুধকে কলোস্ট্রাম বলা হয়; পরে একটি অন্তর্বর্তী অবস্থার মধ্যে দিয়ে দুধটি একটি স্থায়ী প্রকৃতি নেয়। কলোস্ট্রাম শিশু জন্মাবার পর কয়েকদিন মাত্র থাকে। এটি দেখতে হলুদ এবং মাখনের মতো। এমনি দুধের থেকে অনেক ঘন। এটিতে প্রচুর পরিমানে প্রোটিন, ফ্যাটে দ্রবনীয় ভিটামিন, খনিজ এবং ইম্যুনোগ্লোবিন থাকে। ইম্যুনোগ্লোবিন হল অ্যাণ্টিবডি যেটা মা-র দেহ থেকে শিশু সন্তানদের মধ্যে যায় এবং শিশুকে নানান ভাইরাস ও বিজানুঘটিত রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধশক্তি দেয়। নতুন মায়েরা অনেক সময়ে এটি আসল দুধ নয় বলে সন্তানকে না দিয়ে ফেলে দেন, যেটা একেবারেই অনুচিত। সন্তানজন্মের দুচারদিন বাদে কলোস্ট্রাম তৈরি বন্ধ হয়ে যায় এবং অন্তর্বর্তীকালীন দুধের সৃষ্টি হয়। এটি সপ্তাহ দুয়েক থাকে। এই দুধে স্নেহপদার্থ, ল্যাকটোজ, জলে দ্রবনীয় ভিটামিন এবং কলোস্ট্রামের থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি ক্যালোরি থাকে। সপ্তাহদুয়েক পরে মাতৃস্তন্য তার স্থায়ী পরিণত অবস্থায় পৌঁছায়। পরিণত দুধের ৯০ শতাংশ হল জল। শিশুর জলের প্রয়োজন এই দুধ মেটায়। অন্য ১০ শতাংশ হল কার্বো-হাইড্রেট, প্রোটিন এবং স্নেহ পদার্থ।
ক্রেমার ও তাঁর সহযোগীরা তাঁদের গবেষণা করেছেন পূর্ব-ইউরোপের বেলারুস-এর মা ও শিশুদের নিয়ে। মোট ৭,১০৮ জন শিশু যদৃচ্ছাক্রমে বেছে (random sampling) তাদের তিনমাস ধরে শুধু মায়ের দুধ খেতে দেওয়া হয়েছিল। আর এদের সঙ্গে তুলনা করার জন্য আরও ৬,৭৮১টি শিশুকে মায়ের দুধের সঙ্গে অন্যান্য বিকল্প খাবার বা ফর্মুলা দেওয়া হয়েছিল।
এই শিশুদের বয়স যখন ৬.৫ বছর হয়, তখন এদের বুদ্ধি পরীক্ষা করে হয়। দেখা যায় যেসব শিশুরা শুধু মায়ের দুধ খেয়েছে তাদের মোট বুদ্ধ্যাঙ্ক গড়ে অন্যদের থেকে ৫.৯ পয়েণ্ট বেশি। এরমধ্যে তাদের verbal intelligence ** বা বাচনিক বুদ্ধি ৭.৫ পয়েণ্ট বেশি, non-verbal*** বা অবাচনিক বুদ্ধি ২.৯ পয়েণ্ট বেশি। এছাড়া এদের শিক্ষকদের মতে যারা শিশু অবস্থায় শুধু মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়েছে তারা অন্য শিশুদের তুলনায় পড়াশুনোয় ভালো (পড়া ও লেখা দুক্ষেত্রেই)। এই গবেষণার ফলাফল দেখে ক্রেমার ও তাঁর সহযোগীরা নতুন মায়েদের পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁদের শিশুদের অন্ততঃ তিনমাস শুধু স্তনদান করে বড় করতে - পারলে ছয়মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত স্তনদান করতে।
মায়ের দুধের এতো উপকারিতা সত্বেও এই দুধের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন ফর্মুলার প্রস্তুতকারকদের (বিশেষ করে ণএসতলস্ত-র) মার্কেটিং-এর দৌলতে শিশুদের মাতৃস্তন দিয়ে বড় করার স্বাভাবিক ব্যবস্থা দ্রুত গতিতে ভেঙ্গে যাচ্ছিল। প্রথমদিকে এগুলিকে ফর্মুলাকে শিশুদের পক্ষে আদর্শ বলে বিক্রি করা হত। হাসপাতালে এগুলিকে বিলিয়ে, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে, স্বাস্থ্যকর্মীদের সাহায্যে এগুলিকে বিক্রি করা হত। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে যেখানে অনেক মায়েই অপুষ্টিতে ভুগছে, যার প্রভাব তাদের বুকের দুধেও থাকবে, সেখানে এই ধরণের আদর্শ বিকল্পের নিশ্চয় একটা আকর্ষণ ছিল। কিন্তু পরিস্রুত জলের অভাবে গুঁড়ো ফর্মুলা মিশিয়ে দুধের এই বিকল্প বহু শিশুর স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে WHO (ওযার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন) এবং UNICEF (ইউনাইটেড নেশন্স ইণ্টারন্যাশেনাল চিল্ড্রেন্স এমার্জেন্সি ফাণ্ড) ইউনাইটেড ষ্টেটস এজেন্সি ফর ইণ্টারন্যাশেনাল ডেভালপমেণ্ট এবং সুইডিশ ইণ্টারন্যাশেনাল ডেভালপেমণ্ট অথরিটির সঙ্গে একযোগে একটি ঘোষণা (Innocenti Declaration) জারি করেন। এতে বলা হয় মায়েদের স্তন্যদান একটি অদ্বিতীয় পদ্ধতি যেটি শিশুদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগায় এবং অসুখবিশুখ এড়িয়ে তাদের সুস্থ ভাবে বড় হতে সাহায্য করে। এছাড়া, স্তন্যদান মায়েদের স্তন এবং ওভারিয়ান ক্যানসারের হবার সম্ভাবনা কমায়; পরপর দুটি গর্ভধারণের অন্তর্বর্তীকাল বৃদ্ধি করে; সামাজিক এবং আর্থিক দিক থেকে এটি বাঞ্ছনীয়। এই উপকারিতাগুলো বৃদ্ধি পায় যদি জন্মের ছয়মাস পর্যন্ত শিশুদের শুধু মায়ের দুধ খাইয়ে বড় করা হয়।
এই ঘোষণায় বিভিন্ন দেশকে স্তন্যদান করার সংস্কৃতিকে উৎসাহ দিতে অহবান জানানো হয়। মায়েরা যাতে বাধাহীন ভাবে সন্তানকে স্তন্যদান করতে পারেন তারজন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ বিশ্বের দেশগুলিকে সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে যেসব কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিচ্ছে তারা যাতে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপনের উপর যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে - সেগুলি যেন মেনে চলা হয় - সেটা দেখতে হবে। এই নিষেধাজ্ঞাতে বিকল্প ফর্মুলা প্রস্তুতকারকদের সোজাসুজি জনসাধারণকে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মারফতে তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়া বা সেটির ফ্রি স্যাম্প্ল ইত্যাদি দেওয়া চলবে না বলা হয়েছে। তবে এখনও এই নিষেধাজ্ঞা বিকল্প দুধের প্রস্তুতকারকরা সব সময়ে মানছে না। তার প্রতিবাদে 'বয়কট' ও নানা আন্দোলনের কথা এখনও পত্রপত্রিকায় দেখা যায়।

No comments:

Post a Comment